জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যে সময়সীমা দিয়েছিল, তা শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি। কিন্তু, এই অচলাবস্থা নিরসনের কোনো লক্ষণই নেই।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গতকাল শনিবার বলেছে, কেবলমাত্র প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেলেই তারা অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেবে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনা করতে জামায়াতে ইসলামীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে, অন্য একটি রাজনৈতিক দল কেন এমন আমন্ত্রণ জানাবে?

বিপরীতে এই অচলাবস্থা নিরসনের উপায় খুঁজে বের করতে আলোচনা করছে নয়টি দল—এনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল।

গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতা জানান, তারা এখনো বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করেনি।

পাঁচ দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জামায়াতসহ আটটি ইসলামি দল গতকাল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তাদের দাবিগুলো পূরণ না হলে ১১ নভেম্বর সমাবেশ করবে এবং সেখানে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে।

তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করা এবং এ মাসের মধ্যেই গণভোটের আয়োজন করা।

গণভোটের সময়, সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে সরকার গত ৩ নভেম্বর দলগুলোকে আহ্বান জানায় শিগগির একটি অভিন্ন সিদ্ধান্ত জানাতে এবং সম্ভব হলে সেটা যেন সাত দিনের মধ্যে হয়।

ওইদিন উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক শেষে এই সময়সীমা নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা কোনো আল্টিমেটাম দেইনি, আহ্বান জানিয়েছি। আমরা অপেক্ষা করব, তারপর অবশ্যই সরকার সরকারের মতো কাজ করবে।'

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আয়োজিত 'বিপ্লব ও সংহতি দিবস' উপলক্ষে এক আলোচনায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানান।

সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আমরা আপনাদের সমর্থন করেছি, করব ওই সীমারেখার মধ্যে। আর যদি মনে করেন যে আরেকটি রাজনৈতিক দল দিয়ে আমাদের আহ্বান জানাবেন আলোচনার জন্য। তারা কারা? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের আহ্বান জানায় কোনো বিষয়ে আলোচনা করার জন্য যেকোনো ইস্যুতে, আমরা সব সময় আলোচনায় আগ্রহী, যাব। কিন্তু অন্য কোনো একটি রাজনৈতিক দল দিয়ে আমাদের আহ্বান জানানো হচ্ছে কেন?'

তিনি বলেন, তার দল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অন্যান্য দলের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ ও সংলাপ চালিয়ে যায়। তবে অন্য কোনো দলকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা দিয়ে বিএনপিকে পরোক্ষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলে, সেটা শোভনীয় নয়।

সালাহউদ্দিন আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এমন সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই।

এই সরকার নির্বাচিত সরকার নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আপনাদের এ রকম কোনো এখতিয়ার নাই, আমাদেরকে ডিকটেট (আদেশ) করার যে সাত দিনের ভিতরে আপনারা সিদ্ধান্ত না হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের বোধ হয় মানায় না।'

জামায়াতে উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আপনারা যারা ১৯৭১ সালে উল্টা দিকে যাত্রা করেছিলেন, ১৯৪৭ সালে বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, জাতীয় পার্টির হাত ধরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের সহচর হয়েছিলেন, আপনারা আবার যদি আওয়ামী লীগের হাত ধরে পুনরুত্থান চান, কী পরিণতি হবে, আল্লাহ মালুম। আপনারা যা শুরু করেছেন তাতে করে উৎসাহিত হবে পতিত ফ্যাসিস্ট। তাতে উৎসাহিত হবে বাংলাদেশে অন্য যেকোনো রকমের অগণতান্ত্রিক শক্তি।'

'কিন্তু সে জন্য যদি আপনারা বলতে চান যে আপনারা খেতে পারবেন না, সে জন্য বাড়া ভাতে ছাই ছিটিয়ে দিবেন। সেটা বাংলাদেশের মানুষ আর কখনো গ্রহণ করবে না। সেই সুযোগ দেবে না,' যোগ করেন তিনি।

সালাহউদ্দিন বলেন, 'আপনারা ঘি খেতে চান, খান। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথের এই ময়দানকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আর উত্তপ্ত হতে দেব না। ঠিক। আপনারা বলেছেন ১১ তারিখ পর্যন্ত আলটিমেটাম। আলটিমেটাম কারা দিচ্ছেন সরকারকে? তো সরকার তো আপনাদের পক্ষে সুপারিশ দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তো আপনারা যা চান, তাই দিয়েছে। সে জন্য আপনারা তার সাথে সুর মিলিয়ে তাই কথা বলছেন।'

তিনি বলেন, এই গণভোটের মধ্য দিয়ে আইন প্রণীত হয়ে যাবে? এই গণভোটটার মধ্য দিয়ে সংবিধান পরিবর্তিত হয়ে যাবে? কিন্তু একটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা সংসদ সদস্যদের ওপরে এবং আগামী সংসদের ওপরে আরোপিত হবে যে, জনগণ চায় এই সংস্কার বাস্তবায়ন হোক অথবা চায় না। নির্বাচনের দিন ছাড়া গণভোটের বিকল্প নেই।

গতকাল নাগরিক সংগঠন ট্রেস কনসালটিং ফার্ম আয়োজিত 'জনতার ইশতেহার' শীর্ষক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, 'আমরা বিএনপি মহাসচিবকে আলোচনায় বসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। অবশ্য উনারা রিপ্লাই দিয়েছেন জামায়াতের আহ্বানে সাড়া দেবেন না।'

নির্বাচন কাঠামো, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে আলোচনা করতে জামায়াতের দুই সদস্যের কমিটিরও সদস্য আজাদ।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমাদের আলোচনার প্রস্তাবে বেশিরভাগ দল ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। কিন্তু, বৃহস্পতিবার বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়।'

গতকালের অনুষ্ঠানে আজাদ বলেন, 'আমি একটু আবদারের সুরে বলতে চাই, বিগত রেজিম কিন্তু এ রকম একটা স্বরূপ সব সময় বাজাতো—অমুকের সঙ্গে বসবো, অমুকের সঙ্গে বসবো না। সেই কালচার থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না? আপনারা ডাকেন, আমরা যাব। বিএনপি যদি আহ্বান করে, জামায়াত অবশ্যই সবার আগে যাবে এবং অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করবে।'

তিনি বলেন, 'আগামী নির্বাচনের জন্য গণভোট এই জন্যই দরকার সংস্কারের বিষয়গুলো আসলে কী আছে জনগণকে জানতে হবে। কিছুটা হয়তো জনগণ জানে, গণভোটের মাধ্যমে আরও ব্যাপকভাবে জানার সুযোগ আছে।'

গণভোট ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জামায়াত কেন বর্তমান আন্দোলন শুরু করেছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আজাদ বলেন, 'আমরা ডেমোক্র্যাটিক প্রসেসে আগাচ্ছি এবং আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করছি জনমত তৈরি করার জন্য, আমরা প্রেশার গ্রুপ হয়ে কাজ করছি না। আমরা পাবলিকের কাছে যাচ্ছি, ভয়েস রেইজ করছি, সরকারকে আমরা কনভিন্স করার চেষ্টা করছি।'

একই অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'এ দেশের মানুষ ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করে।'

তিনি বলেন, 'কথায় কথায় আপনি রাস্তায় যাবেন। এখন অন্য দল যদি তার প্রতিবাদে আবার রাস্তায় যায়, তাহলে কী হবে, সংঘর্ষ হবে না? বৃহত্তর দল বাংলাদেশে যদি রাস্তায় নামে এগুলোর প্রতিবাদে, সংঘর্ষ হবে। এ জন্য কি আমরা শেখ হাসিনাকে বিদায় করেছি?'

প্রতিবাদের অধিকার সবার আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি চায় না, তারা চায় স্থিতিশীলতা।

বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, 'যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে। যেগুলোয় ঐকমত্য হয়নি, তা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে।'

একই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, 'অনেক দল এখনো বলছে, জুলাই সনদ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ ধরনের বিতর্ক কিন্তু পৃথিবীর অনেক জায়গায় ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে চলে। দ্বিমত থাকবে, তারপর ঐকমত্য হবে।'

মতভেদ থাকলেও শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য তৈরির প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, 'দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সরকার তার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব অনুসারে একটা সিদ্ধান্ত দেবে।'