আজ ১০ নভেম্বর, ঐতিহাসিক বিলোনিয়া মুক্ত দিবস। মুক্তিযুদ্ধের আজকের দিনে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্ত হয়েছিল ফেনীর বিলোনিয়া বার্জ।

বিলোনিয়া যুদ্ধে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রচলিত যুদ্ধে (কনভেনশনাল ওয়ার) আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও দুঃসাহসিক যুদ্ধগুলোর একটি ছিল বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ। দুই পর্বে সংঘটিত বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত। অন্যদিকে ৫ নভেম্বর শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্ব চলেছিল ৯ নভেম্বর পর্যন্ত।

বিলোনিয়া যুদ্ধের মতো রণকৌশল, দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আক্রমণের সফলতা মুক্তিযুদ্ধের খুব কম যুদ্ধেই রচিত হয়েছিল।

বর্তমানে বিশ্বখ্যাত বহু সামরিক কলেজের পাঠ্যসূচির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধের রণকৌশল পড়ানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধে বিলোনিয়া যুদ্ধের রণাঙ্গন ছিল ফেনীর তিনটি উপজেলা—পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়াজুড়ে বিস্তৃত। তিন দিকে ভারতীয় সীমান্তবেষ্টিত এই এলাকাটির দৈর্ঘ্য ১৬ মাইল ও প্রস্থ ছয় মাইল।

বিলোনিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত) ইমাম-উজ-জামান বীর বিক্রম। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুরুতেই আমরা দেখলাম বিলোনিয়াকে যদি দক্ষিণ দিক অবরুদ্ধ করা হয়, তাহলে এটি মুক্তাঞ্চলে পরিণত হবে। আর একবার বিলোনিয়া দখল করতে পারলে আমাদের পক্ষে ফেনীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখল করাও সম্ভব হবে এবং সাগর পথে চট্টগ্রামে আসা পাকিস্তানিদের দেশের অন্যান্য অঞ্চলে রিএনফোর্সমেন্ট আমরা বন্ধ করে দিতে পারবো।'

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় থেকেই বিলোনিয়াকে শত্রুমুক্ত করে মুক্তাঞ্চল করার পরিকল্পনা করে মুক্তিবাহিনী।

বিলোনিয়াকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে ১ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত দুই নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাব সেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন (লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) জাফর ইমাম বীর বিক্রমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিত যুদ্ধের পরেও বিলোনিয়াকে শত্রুমুক্ত করতে পারেননি। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রবল আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। টানা ২২ দিন ধরে চলা বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধে ৬২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন।

বিলোনিয়া দখল করতে না পারলেও ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার রণাঙ্গনে একের পর এক গেরিলা আক্রমণ ও খণ্ড যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে দিশাহারা করে তুলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।

বিলোনিয়াকে শত্রুমুক্ত করতে একাত্তরের সেপ্টেম্বরে পুনরায় পরিকল্পনা শুরু হয়। ১০ অক্টোবর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির নিয়মিত সেনাদের একাংশ ও রাজনগর সাব সেক্টরের প্রশিক্ষিত কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।

সে সময় মুক্তিবাহিনীর উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হয়, দ্বিতীয় বিলোনিয়ার যুদ্ধে দশম বেঙ্গলের চারটি কোম্পানির পাশাপাশি ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি ও ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে এক নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেবেন। দশম বেঙ্গলের আলফা কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান, ব্রাভো কোম্পানির লেফটেন্যান্ট মিজান ও চার্লি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট দিদার।

ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদককে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম ও মেজর জেনারেল (অব.) ইমাম-উজ-জামান বীর বিক্রম পৃথক দুটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাদের ভাষ্য, ৬ নভেম্বর আক্রমণের মূল দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল।

৫ নভেম্বর ছিল বৃষ্টিমুখর এক শীতের রাত, টানা বর্ষণের মধ্যে বজ্রপাতের তীব্র শব্দ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সীমান্ত দিয়ে একে একে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

প্রথমে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দশম বেঙ্গলের একদল মুক্তিযোদ্ধা সীমান্তবর্তী উত্তর চিথলিয়া ও চন্দনা হয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এরপর লেফটেন্যান্ট মিজানের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি ও লেফটেন্যান্ট দিদারের নেতৃত্বে ডেল্টা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা মুহুরি নদী অতিক্রম করেন। ক্যাপ্টেন হেলালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মুহুরি নদী অতিক্রম করে সলিয়ার দিকে এগিয়ে যান। অন্যদিকে আলফা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যান চিথলিয়ার দিকে। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মাহফুজের কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা গুথুমা দিয়ে ঢুকে ব্রাভো কোম্পানির সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘেরাও পর্ব শুরু করেন।

পাকিস্তানি বাহিনী তখনো বুঝতে পারেনি এই গভীর রাতে তাদের নাকের ডগা দিয়ে কী করে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের ফাঁদ রচনা করে চলেছেন। সেই গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা চিথলিয়া, গুথুমা, সলিয়া, ধনিকুণ্ডা, চন্দনাসহ বিভিন্ন স্থানে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। একইসঙ্গে বিলোনিয়া থেকে ফেনী অভিমুখী রেললাইনের দুইপাশে বাঙ্কার খনন করা হয়।

৬ নভেম্বর সকালে বাঙ্কারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা দূর থেকে একটি রেলওয়ে ট্রলি আসতে দেখেন। ট্রলিতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সলিয়ার দিকে এগিয়ে আসছিল। ট্রলিটি মুক্তিযোদ্ধাদের আওতাধীন এলাকায় ঢুকতেই অতর্কিত গুলি চালান মুক্তিযোদ্ধারা। ট্রলিতে থাকা এক অফিসার ও পাঁচ পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

বাঙ্কার থেকে লাফিয়ে উঠে অফিসারের ব্যাজ নিতে গেলে পাকিস্তানিদের গুলিতে হাবিলদার এয়ার আহমেদ বীর বিক্রম শহীদ হন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের দখল নেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির শব্দে মুহূর্তেই সজাগ হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনারা। তারা বিভিন্ন অংশ থেকে আক্রমণ শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব দেন এবং রাতের মধ্যেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

৬ নভেম্বর দিনব্যাপী চলা যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে ওয়্যারলেসে ফেনী ঘাঁটিতে সেনা সহায়তা ও সদর দপ্তরে বিমান হামলা চালানোর সহায়তা চায়। ৭ নভেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী এফ ৮৬ স্যাবর জেট দিয়ে বিমান হামলা শুরু করে।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী। ৮ নভেম্বর চারটি স্যাবর জেট দিয়ে পুরো এলাকায় বোমাবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। বাঙ্কারে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে থাকলেও সেই হামলায় বেসামরিক বহু বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা মাঝারি মেশিনগান দিয়েই বিমান হামলা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন।

বিলোনিয়া যুদ্ধের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিমান হামলার জবাব কী করে দেবো প্রথমে আমরা বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমাদেরই কয়েকজন সুবেদার মেজর, সুবেদার, হাবিলদারেরা এসে বললেন, এভাবে আর চলবে না স্যার। ওরা আগামী কয়েক দিনে আবার আসবে। আমাদের কাছে যেহেতু অ্যান্টি এয়ারক্রাফট নেই, তাই আমরা গাছ কেটে আড়াআড়িভাবে ঠেঙ্গা বানিয়ে তার উপরে এমএমজি বসিয়ে ওটাকেই এন্টি এয়ারক্রাফট হিসেবে ব্যবহার করব। শেষ পর্যন্ত তাই হলো।'

৯ নভেম্বর সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর স্যাবর জেট উড়ে এলে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা মাঝারি মেশিনগান দিয়ে বাঙ্কার থেকেই আক্রমণ গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে ব্রাভো কোম্পানির হাবিলদার হাশমতের ছোড়া মেশিনগানের গুলি স্যাবর জেটে গিয়ে লাগে। ভারতীয় বাহিনীর রাডারে দেখা যায়, স্যাবর জেটটি পরবর্তীতে কুমিল্লার লাকসামে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। এরপরই পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলা বন্ধ হয়ে যায়। পতন কেবল সময়ের অপেক্ষা বুঝতে পেরে শেষ দিকে মরণ কামড় বসায় অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনী।

ওই রাতে ভারতীয় আর্টিলারির ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে থাকা ব্রিগেডিয়ার সান্ধুর তৃতীয় ডোগরা রেজিমেন্টের প্রবল আর্টিলারি হামলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর সমস্ত প্রতিরোধ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী বাধ্য হয়ে তখন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়।

১০ নভেম্বর রাতে পরশুরাম ও চিথলিয়াতে একজন অফিসারসহ মোট ৭২ জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

বিলোনিয়া যুদ্ধের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে এটিই ছিল প্রথম কোনো আত্মসমর্পণের ঘটনা। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বহু বিশ্বখ্যাত সামরিক কলেজগুলোতে বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে পড়ানো হয়।'

বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও কমনওয়েলথ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের সামরিক কলেজগুলোতে দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল পড়ানো হয়। এর মধ্যে ভারতে রয়েছে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি, রাষ্ট্রীয় ইন্ডিয়ান মিলিটারি কলেজ, ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমি, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ।

তথ্য সূত্র: 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র নবম খণ্ড', 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২)', 'Liberation war 71 & The Battles of Feni Belonia/ Jafar Imam BIr Bikram'.