একসময় শিশু বাছিত খান মুসার মুখে হাসি লেগেই থাকত। বাবার স্বপ্ন ছিল, ছেলে বড় হয়ে পাইলট হবে। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। শিশু মুসার দিন কাটে হুইলচেয়ারে। তার নাকে টিউব, ডানপাশ পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত।

এই ছয় বছরের শিশুটি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি। রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সে গত বছর জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশি নৃশংসতার শিকার। ১৯ জুলাই সে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিটি তার মাথার এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। একই গুলিতে তার দাদিও মারা যান।

বিভিন্ন হাসপাতালে এবং সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ চিকিৎসার পর অলৌকিকভাবেই বেঁচে যায় মুসা। 

গতকাল সোমবার মুসা তার বাবা ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসায়ী মো. মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ উপস্থিত হয়। মামলা সংক্রান্ত সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তার বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। 

এই মামলায় অভিযুক্ত চার পুলিশ কর্মকর্তা। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানও রয়েছেন। মুস্তাফিজুর এই মামলার দ্বিতীয় অভিযোগকারী সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

মুস্তাফিজুর বলেন, 'পুলিশের গুলি আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। আমি আমার মাকে হারিয়েছি। এখনো একমাত্র সন্তানের চিকিৎসার জন্য সব চেষ্টা করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'মুসা হাঁটতে বা কথা বলতে পারছে না, কিন্তু সে সব বোঝে। নল দিয়ে তাকে খাওয়াতে হয়।' এসব বলতে গিয়ে গলা কাঁপছিল মুস্তাফিজুরের।

দ্য ডেইলি স্টার আদালতের কক্ষে মুসার কাছে জানতে চায়, সে কেমন আছে। সে আঙুল তুলে বোঝাল, 'ঠিক আছে'।

মুস্তাফিজুর বলছিলেন কীভাবে জুলাইয়ের এক বিকেলে মুহূর্তে সবকিছু পাল্টে গেল। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে, তিনি তার মা ও ছেলেকে নিয়ে রামপুরার বাড়ি থেকে নিচে নেমে আইসক্রিম কিনতে যান। 'বাইরে থেকে ছোড়া একটি গুলি আমার ছেলের মাথায় লাগে, সেটি অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়,' বলেন তিনি। 

বাইরে গুলিবর্ষণ শুরু হলে তিনি মুসাকে দ্রুত স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। কয়েক ঘণ্টা পরে তিনি জানতে পারেন, তার মা অন্য একটি হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা গেছেন।

মুস্তাফিজুর বলেন, তিনি রামপুরা থানার তৎকালীন ওসি মশিউর রহমানকে গুলি করতে দেখেছেন। 'যারা আমার মাকে হত্যা করেছে এবং আমার ছেলের জীবন ধ্বংস করেছে, তাদের বিচার চাই।'

ঢামেক হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এবং পরে সিঙ্গাপুরে একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে শিশু মুসার। কয়েক মাস ধরে চিকিৎসার পরও সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং অন্যদের ওপর নির্ভরশীল।

এই মামলায় গ্রেপ্তার একমাত্র অভিযুক্ত রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন সহকারী উপ-পরিদর্শক চঞ্চল চন্দ্র। তার আইনজীবীর জেরাকালে সাক্ষী বলেন, তার মায়ের মরদেহের কোনো ময়নাতদন্ত করা হয়নি। পুলিশ ঢামেককে বললে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

মুস্তাফিজুর বলেন, পুলিশ তার বাবাকে জোর করে মরদেহ টাঙ্গাইলের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করতে বাধ্য করে। 'ছেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক থাকায় আমি মায়ের জানাজায়ও যেতে পারিনি।'

শুনানির পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মুস্তাফিজুর বলেন, 'মুসা তার ক্লাসে সেরা ছিল... তার সামনে পুরো জীবন পড়ে ছিল। সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছে।'

এক প্রেস ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি ট্রাইব্যুনালে যথাযথ ন্যায়বিচার নিয়ে কোনো সন্দেহ বোধ করেন কি না। তিনি বলেন, আদালতে স্বচ্ছতার অভাব নেই এবং তার বিশ্বাস, এটি কোনো 'ক্যাঙারু কোর্ট' নয়।

আমির হোসেন এ মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পক্ষেরও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী।