সংস্কার উদ্যোগ ঘিরে দেশে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে গণভোট। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে জনগণের সরাসরি মতামত জানার এই প্রক্রিয়াই মূলত গণভোট, যা ইংরেজিতে পরিচিত 'রেফারেন্ডাম' নামে। গণভোটে সাধারণ নাগরিকরা ভোটের মাধ্যমে জানিয়ে দেন—কোনো প্রস্তাব তারা গ্রহণ করছেন, নাকি প্রত্যাখ্যান করছেন। অর্থাৎ, সংসদ বা সরকারের পরিবর্তে সিদ্ধান্ত দেয় জনগণ।

বহু দেশেই গণভোট আয়োজনের ইতিহাস রয়েছে। তবে অল্পকিছু দেশই এর প্রকৃত সফলতা পেয়েছে। সুইজারল্যান্ড থেকে শুরু করে নরওয়ে, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য—দেশগুলোতে জনগণের রায় সত্যিই বদলে দিয়েছিল রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। অন্যদিকে, কিছু গণভোটের প্রভাব ছিল সীমিত।

গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সে, যখন নাগরিকদের সরাসরি মতামত নেওয়া হয় নতুন সংবিধান (মন্টানিয়ার্ড কন্সটিটিউশন) অনুমোদনের বিষয়ে। জনগণ ভোটের মাধ্যমে জানান তারা সংবিধানটি গ্রহণ করছেন, নাকি প্রত্যাখ্যান করছেন।

তবে,  আধুনিক ফ্রান্সে ভিন্ন ধরনের এক গণভোট হয় যা 'প্লেবিসাইট' নামে পরিচিত। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ফ্রান্স বড় আকারের জাতীয় ভোটের সূচনা করে। প্লেবিসাইট মূলত জনগণের সরাসরি অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে রাষ্ট্রপতি বা সরকার নির্দিষ্ট প্রস্তাব বা নীতিকে জনগণের কাছে সরাসরি উপস্থাপন করে।

ভোটে প্রায় সব অংশগ্রহণকারী নাগরিক নতুন সংবিধানের পক্ষে রায় দেন। এটি ফরাসি বিপ্লবের পর রাষ্ট্রের কাঠামো ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এটি ছিল এককালীন আয়োজন, যা স্থায়ী বা নিয়মিত প্রক্রিয়া হিসেবে গড়ে ওঠেনি।

বিশ্লেষকদের মতে, ফ্রান্সে প্রথম এই ধরনের গণভোট বা প্লেবিসাইট শুধু ইতিহাসে পথপ্রদর্শক নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশে জাতীয় ভোট ও সরাসরি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

পরে ১৯৫৮ সালে ফরাসি নেতা চার্লস দ্য গল নতুন সংবিধান অনুমোদনের জন্য গণভোটের আয়োজন করেন। জনগণের বিপুল সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্র বা ফিফথ রিপাবলিক—যা আজও কার্যকর রয়েছে। এই গণভোট ফরাসি রাজনীতিতে স্থিতিশীলতার নতুন অধ্যায় সূচনা করে।

সর্বশেষ ২০০৫ সালে দেশজুড়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেছিল ফ্রান্স।

গণভোটের ইতিহাসে ফ্রান্সের অবদান অনস্বীকার্য। তবে বিশ্বের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মিত গণভোটের জন্মভূমি ফ্রান্স নয় সুইজারল্যান্ড। দেশটিতে নাগরিকদের সরাসরি ভোটের শুরু হয় ১৮০২ সালে, তখন দেশের নাগরিকদের মতামত আংশিকভাবে নেওয়া হয়। এটি প্রথম পদক্ষেপ হলেও ছিল অস্থায়ী এবং আংশিক।

এরপর ১৮৪৮ সালে সুইজারল্যান্ডে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর গণভোটকে স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। তখন থেকে সুইস নাগরিকরা নিয়মিতভাবে জাতীয় ও স্থানীয় স্তরে আইন, নীতি এবং সংবিধান সংশোধনে ভোট দিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্ধারণে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন।

ফ্রান্সে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হলেও, সুইজারল্যান্ডই গণভোটকে কার্যকর ও নিয়মিত প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাই বিশ্বের প্রাতিষ্ঠানিক গণভোটের জন্মভূমি হিসেবে সুইজারল্যান্ডের নাম স্বীকৃত। 'প্লেবিসাইট' থেকে 'রেফারেন্ডাম' নামকরণের উৎপত্তি এবং এর প্রাথমিক কাঠামোও সুইজারল্যান্ডে তৈরি হয়।

এখনো সুইজারল্যান্ডে বছরে একাধিক গণভোট হয় এবং সরকার জনগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করে। একে বলা হয় 'সরাসরি গণতন্ত্র'-র জন্মভূমি।

১৯০৫ সালে নরওয়ের জনগণ গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করে তারা আর সুইডেনের অধীনে থাকবে না। ভোটে বিপুল সমর্থনে নাগরিকরা স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন। এর ফলশ্রুতিতে নরওয়ে জন্ম নেয় একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে।

একে ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল গণভোটগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে ধরা হয়। নাগরিকদের সর্বাধিক অংশগ্রহণ এবং প্রায় সার্বজনীন সমর্থন এই ভোটকে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করেছে।

নরওয়ের এই গণভোট কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেনি, বরং সরাসরি গণতন্ত্রের কার্যকর প্রয়োগের এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে ইউরোপের রেকর্ডে রয়েছে।

২০১৬ সালের 'ব্রেক্সিট' গণভোটে যুক্তরাজ্যের জনগণ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বের হবে। ভোটে ইইউ ত্যাগের পক্ষে বিপুল সমর্থন পায়। সরকার সেই রায় মেনে নেয় এবং ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ থেকে বের হয়ে আসে।

গণভোটটি আধুনিক গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছার সরাসরি প্রয়োগের এক ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি দেখিয়েছে, কীভাবে নাগরিকদের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখা সম্ভব।

তুরস্কে জাতীয় পরিসরে এখন পর্যন্ত সাতটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি ভোটই ছিল সংবিধান সংশোধন বা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গণভোটগুলো দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও সংবিধানিক প্রক্রিয়াকে নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে বিতর্কও রয়েছে। 

১৯৬১ সালের ৯ জুলাই তুরস্কে প্রথম জাতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই গণভোট ছিল ১৯৬০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশকে সংবিধানিক পথে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা। সরকারিভাবে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, ভোটারদের ৬২ শতাংশ 'হ্যাঁ' ভোট দেন এবং ৩৮ শতাংশ 'না' ভোট পড়ে। ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৮১ শতাংশ।

১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর তুরস্কে দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল ১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর নতুন সংবিধান অনুমোদন। সরকারি ফল অনুযায়ী, ভোটারদের ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ 'হ্যাঁ' ভোট দেন। ভোটার উপস্থিতি প্রায় ৯১ শতাংশ।

১৯৮৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত গণভোটের বিষয় ছিল রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি। এই ভোটে ফলাফলের পার্থক্য খুব কম ছিল, 'হ্যাঁ' ৫০ দশমিক ২ শতাংশ এবং 'না' ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা তুরস্কে ভোটের প্রতি জনগণের ব্যাপক আগ্রহকে দেখায়।

১৯৮৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় নির্বাচন এক বছর আগে করার প্রস্তাব নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটে ৬৫ শতাংশ ভোটার 'না' বলেন এবং প্রস্তাব বাতিল হয়।

২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর তুরস্কের সংবিধানে পাঁচটি সংশোধন প্রস্তাব নিয়ে গণভোট আয়োজন করা হয়। সরকারি সূত্র অনুযায়ী, প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ভোটার উপস্থিতি ও ফল বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি।

২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তুরস্কে অনুষ্ঠিত গণভোটে ২৬টি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, 'হ্যাঁ' ৫৮ শতাংশ এবং 'না' ৪২ শতাংশ, যা সংবিধান সংশোধনের অনুমোদন দেয়।

২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল তুরস্কে সবচেয়ে বিতর্কিত গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল সংসদীয় ব্যবস্থার বদলে প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

সরকারি ফলাফলে দেখা যায়, 'হ্যাঁ' ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং 'না' ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ভোটার উপস্থিতি প্রায় ৮৫ শতাংশ। ফলাফলে অল্প ব্যবধান এবং উচ্চ ভোটার উপস্থিতি এই গণভোটকে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও বিতর্কিত করেছে।

গণভোটকে বিতর্কিত বলা হচ্ছে মূলত—ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং ভোট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে ওঠা প্রশ্নের কারণে। নতুন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়ন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগে সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। সমালোচকেরা মনে করেন, এটি ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, যা গণতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

ভোটের পরিবেশ নিয়েও তখন বিতর্ক দেখা দেয়। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে, ভোটের সময় মিডিয়া ও প্রশাসন সরকারপক্ষীয় ছিল। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মিশ্র বার্তা দেন। যদিও ভোট শান্তিপূর্ণ ছিল, তবে প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

ফলাফলের সামান্য ব্যবধানও বিতর্কের একটি কারণ। মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবধানের কারণে ভোটের ফল অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে এবং দেশের রাজনৈতিক বিভাজন আরও গভীর হয়।

গণভোটের মাধ্যমে তুরস্কে সংসদীয় থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সরকার কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের কারণে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।

চিলিতে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। যা দেশটির রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ও সংবিধানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই গণভোটগুলোতে নাগরিকদের সরাসরি ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের শাসন ও সংবিধান নির্ধারণ করা হয়েছে।

১৯৮৮ সালের গণভোট: পিনোশের শাসনের অবসান

চিলিতে ১৯৮৮ সালে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল আগুস্তো পিনোশের শাসন এক বছর বাড়ানো হবে কি না। প্রায় ৫৬ শতাংশ ভোটার 'না' বলেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে পিনোশের একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি চিলির সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা দেশকে ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক পথে ফিরিয়ে আনে।

২০২০ সালে চিলিতে দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে নাগরিকদের জিজ্ঞেস করা হয় নতুন সংবিধান প্রণয়নের অনুমোদন এবং সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া। ফলাফলে দেখা যায়, প্রথম প্রশ্নে প্রায় ৭৮ শতাংশ ভোটার 'হ্যাঁ' বলেন এবং দ্বিতীয় প্রশ্নে প্রায় ৭৯ শতাংশ ভোটার সমর্থন করেন। যা নাগরিকদের নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য স্পষ্ট মত প্রকাশ করে।

চিলিতে ২০২২ সালে তৃতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে নাগরিকদের সামনে ছিল নতুন সংবিধান অনুমোদনের প্রশ্ন। ফলাফলে ৬২ শতাংশ ভোটার 'না' বলেন। পক্ষে ভোট পড়েছে ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন সংবিধান প্রস্তাব বাতিল হয়। নাগরিকদের এই সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছে সংবিধান প্রস্তাবের জটিলতা ও রাজনৈতিক উদ্বেগ। ভোটাররা নতুন সংবিধান প্রণয়নের পরিবর্তে বর্তমান কাঠামোর স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সময়ে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক গণভোট এবং একটি সাংবিধানিক গণভোট।

দেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকাজের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য। ভোটের মাধ্যমে দেশের জনগণ জানান, রাষ্ট্রপতি এবং তার নীতি ও কর্মসূচির প্রতি তারা আস্থা রাখেন কি না।

১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল গণভোটের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলা ভোটগ্রহণ দেশের ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। তখন দেশের মোট ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৪ লাখ।

ফলাফলে দেখা যায়, ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ ভোটার ভোটে অংশ নেন। এর মধ্যে 'হ্যাঁ' ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ, অন্যদিকে 'না' ভোট ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ।

১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির বৈধতা যাচাইয়ের জন্য। ভোটাররা 'হ্যাঁ' বা 'না' বাক্সে ভোট দেন। আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ 'হ্যাঁ' বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে 'না' বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ভোটার অংশগ্রহণের হার ছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে 'হ্যাঁ' ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং 'না' ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন এরশাদ। এরপর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে বিল পাস হয়।

সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।

ভোটে অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোটার 'হ্যাঁ' ভোট দিয়ে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ ভোটার 'না' ভোট দেন।

২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে গণভোটের বিষয়টি সামনে আসে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের বৈধতা নিশ্চিত করতে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।

গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে 'জুলাই জাতীয় সনদ' বাস্তবায়নের সুপারিশমালা আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।

জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং এর তফসিলে সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হবে।

গণভোটের ব্যালটে দুটি প্রশ্ন থাকবে—

আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?

ভোটারদের এই প্রশ্নের উত্তরে ব্যালট পেপারে 'হ্যাঁ' বা 'না' ভোট দিয়ে নির্ধারিত বাক্সে প্রদান করতে হবে।

তফসিল-১-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কমিশনের আলোচনায় নেওয়া সংবিধানের ৪৮টি সংশোধন প্রস্তাব। গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে এসব সংশোধনী বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের 'নোট অব ডিসেন্ট' বা ভিন্নমত সংযোজিত থাকলেও, চূড়ান্ত তফসিলে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদও গঠন করা হবে, যা সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে 'গাঠনিক ক্ষমতা' প্রয়োগ করার অধিকার রাখবে।

কমিশন জানিয়েছে, বাস্তবায়ন আদেশ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায়, তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

অন্যদিকে কমিশনের আলোচনায় নেওয়া সংবিধানের ৪৮টি সংশোধনের মধ্যে কোনো একটি বিষয়ে যদি সমর্থন থাকে, আবার কিছুতে না থাকে, তবে গণভোটে আলাদা আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই।

আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ' জারির মাধ্যমে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে 'পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল' অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বাদ রাখা হয়েছে। তবে ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা দ্বিতীয় বিকল্পে রাখা হয়েছে।

ঐকমত্য কমিশন প্রণীত আদেশে গণভোট কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদের গঠন ও কার্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে।

খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, 'এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা হইবে।'

আদেশে বলা থাকবে, 'জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হইবে।'

খসড়া আদেশে বলা হয়, গণভোটে উপস্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে প্রদত্ত সংখ‌্যাগরিষ্ঠ ভোট ইতিবাচক বা হ্যাঁ সূচক হইলে এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হইবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার) প্রয়োগ করিতে পারিবে।

'উক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে এবং এই আদেশ অনুসারে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করিবেন।'

'পরিষদ উহার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এই আদেশের তফসিল-১ এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করিবে এবং তাহা সম্পন্ন করিবার পর পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হইবে।'

জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একইসঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবেও শপথ করবেন, এমন বিধান খসড়া আদেশে রেখেছে ঐকমত্য কমিশন। তাদের শপথবাক্যও নির্ধারণ করা হয়েছে আদেশের দ্বিতীয় তফসিলে।