প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটে আনতে যে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা সাজিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি), তাতে কতটা সাড়া মিলবে তা নিয়ে সংশয় থাকলেও এই ভোট পেতে জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে জামায়াতে ইসলামী।

দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যে তারা অনলাইন সভার মাধ্যমে কিংবা সশরীরে গিয়ে বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। প্রবাসীদের ভোটে আনতে উৎসাহিত করতে পরামর্শ সভা করেছেন সেখানকার স্থানীয় কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশসহ ১১টি দেশের বিভিন্ন স্টেশনে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চলাকালীন স্থানীয়দের সঙ্গে প্রবাসী জামায়াত নেতাকর্মী ও সমর্থকরাও তৎপর ছিলেন বলে দাবি করেছেন তারা।

এর পাশাপাশি প্রবাসী ভোটাররা কীভাবে নিবন্ধন করবেন, কীভাবে ব্যালট পেপার পাবেন, কীভাবে সেটা ফেরত পাঠাবেন—এসব বিষয় নিয়ে এখনো প্রচারণা চালাচ্ছেন জামায়াত নেতাকর্মীরা।

যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকা জামায়াত আমির শফিকুর রহমানও সম্প্রতি নিউইউর্ক সিটি ও বাফেলোতে আয়োজিত অন্তত দুটি সভায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জামায়াত নির্বাচিত হলে জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তারও আগে দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে স্থানীয় বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে নিজ দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানোর পাশাপশি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শরিক হওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়ে এসেছেন।

দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের ভাষ্য, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটে আনার ক্ষেত্রে শুরু থেকে তারা সরব ছিলেন। এখন যখন এমন সুযোগ তৈরি হয়েছে, তারা সেটাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে দেশের বাইরে প্রবাসীদের মাঝে জামায়াতের নতুন ভাবমূর্তি গড়তে চান। এ কারণে অভ্যুত্থানের পরে তারা যখনই যেই দেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে তাদের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যত বেশিসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে মতবিনিময় করা ও ভোট সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা চালানো।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটে আনতে ইতোমধ্যে নতুন অ্যাপ তৈরিসহ পদ্ধতি উন্নয়নে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বিদেশে ব্যালট পাঠানো এবং বিদেশ থেকে আনাসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ব্যয় প্রাক্কলন করেছে সংস্থাটি।

এর বাইরে প্রবাসে এনআইডি সেবা দিতে বাংলাদেশ মিশনে যন্ত্রপাতি স্থাপন ও প্রশিক্ষণে ইসি কর্মকর্তারা দফায় দফায় বিদেশ সফর করেছেন।

ইসির এনআইডি অনুবিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত প্রবাসীদের নিবন্ধনের জন্য মোট আবেদন পড়েছে ৬১ হাজার ১১৯টি। দূতাবাস অফিসে বায়োমেট্রিক সম্পন্ন হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৯০ জনের। তদন্ত সম্পন্ন হয়ে আবেদন অনুমোদন হয়েছে ২৫ হাজার ৭১১ জনের। অপেক্ষমান আছে এক হাজার ৩৬টি আবেদন। বাতিল হয়েছে ৫ হাজার ১৩৬ জনের আবেদন। তদন্ত অপেক্ষমান আছে ২৯ হাজার ২৪৭ জনের। 

এছাড়া ইসির সার্ভারে আপলোড হয়েছে ২০ হাজার ৬৭৬টি জনের এনআইডির তথ্য। এ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ছাপানো ও বিতরণ হয়েছে ১৫ হাজার ৩১টি; যা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও আবুধাবি, সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দা, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেষ্টার ও বার্মিংহাম, ইতালির রোম ও মিলান, কুয়েতের কুয়েত সিটি, কাতারের দোহা, মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা ও সিডনি, কানাডার অটোয়া ও টরোন্টো, জাপানের টোকিও, আমেরিকার নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, মিয়ামি ও লসঅ্যাঞ্জেলস—এই ১১টি দেশের ২১টি স্টেশনে এই কার্যক্রম চলেছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটে আনার বিষয়ে জামায়াতের যে তৎপরতা সেটাকে 'রাজনৈতিক দায়িত্ব' হিসেবে অভিহিত করেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ভোটার হওয়ার সুযোগ পেলে তারা (প্রবাসীরা) যেন ভোটার হন, প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করেন, নিবন্ধন করে ফেলেন—এসব ব্যাপারে আমরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছি। দেশের রাজনীতিতে যে তাদেরও গুরুত্ব রয়েছে সে বিষয়টিও তো তাদের মধ্যে বিল্ড করতে হবে। এটা তো প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হওয়া উচিত।'

বিষয়টি নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের সঙ্গে। তিনি তখন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থান করছিলেন।

এই জামায়াত নেতা বলেন, 'আমাদের আমির ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরসহ আমিও বিভিন্ন দেশ একাধিকবার সফর করেছি। বিভিন্ন প্রবাসী গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমি অলরেডি এখন লন্ডনে আছি। ২৩ তারিখে এসেছি। ২৪ তারিখ থেকে প্রতিদিনই এখানকার নারী-পুরুষসহ কমিউনিটি লিডারশিপে যারা আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদেরকে গাইড করছি। এনআইডি, ভোটার অ্যাপসহ যে বিষয়গুলোতে জটিলতা আছে সেগুলো নিরসনে পরামর্শ দিচ্ছি।

'লন্ডন এবং লন্ডনের বাইরে বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার ও আমেরকিার অনেকগুলো রাজ্যে (ইসি) সেন্টারের কার্যক্রম চলছে। এই সমস্ত কাজে যাতে সহযোগিতা ওনারা (প্রবাসীরা) পান, কমিউনিটি নেতারা যেন আমাদের ভাইবোনেরা (কর্মী-সমর্থকরা) সহযোগিতা করেন সে ব্যাপারে কথা বলছি। ভোটার হওয়া ও পরবর্তীতে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেন কোনো অসুবিধা না হয় এ সমস্ত বিষয় নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মতবিনিময় হচ্ছে, পরামর্শ দিচ্ছি, গাইড করছি।'

এই জামায়াত নেতারা ভাষ্য, 'আমরা এটা সিরিয়াসলি নিচ্ছি। কারণ যারা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা, দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় অবদান তাদের। সুতরাং আমাদের সবারই দায়িত্ব হচ্ছে নেতৃত্ব নির্বাচনে বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেন তারা অংশ নিতে পারেন। ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন।'

এক্ষেত্রে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও এখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন এহসানুল মাহবুব।

তিনি আরও বলেন, 'জুম মিটিংয়ে ৩০ থেকে ৪০টা দেশে মিটিং করেছি। ইসিতে কী কী হচ্ছে, কী সমস্যা কমিউনিটির লোকজন ফেস করছেন এসব নিয়ে কথা বলছি। পরামর্শ দিচ্ছি। ওনারাও পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব পরামর্শ নিয়ে আমরা ইসিতেও দেখা করেছি।'

আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে গত ২৮ অক্টোবর মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনকে ১৮ দফা সুপারিশ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সেখানেও প্রবাসী ভোটারদের ভোট প্রদানের পদ্ধতি সহজ করার জন্য ভোটার আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট যেকোন একটির মাধ্যমে ভোট প্রদানের সুযোগ দেওয়া ও রেজিস্টার্ড প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে।

এই বিষয়টির ওপর জোর দিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার বলেন, 'ইলেকশন কমিশনের জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ যে, কী পরিমাণ তারা আনতে পারবেন। আর আমাদের দাবি হলো রেজিস্ট্রেশনের কাজ হয়ে গেলে প্রবাসী ভোটারদের তালিকা যেন যৌক্তিক সময়ের আগেই পলিটিক্যাল পার্টিগুলো পেতে পারে।'

আবার প্রবাসী ভোটের ক্ষেত্রে 'সময়' একটা সমস্যা হবে মন্তব্য করে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, 'ভোটের সময় টাইমিংয়ের বিষয়টা একেক দেশে একেকরকম থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা ইসিকে পরামর্শ দিয়েছি অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা জানার জন্য। যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে প্রবাসীরা তাদের ভোটটা দিতে পারেন।'

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীমের সঙ্গে। তার ভাষ্য, 'সব ভোটই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটা ভোটই সমান ওয়েট ক্যারি করে; সেটা দেশের বাইরে হোক কিংবা ভেতরে। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে যারা ওভারসিজ ভোটিং প্র্যাকটিস করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টার্নআউট খুব পুওর। হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাদ দিলে। যারা প্রবাসী ভোটার তাদের উৎসাহ উদ্দীপনাও কম থাকে।'

'এর নানারকম কারণ আছে এবং কারণগুলো নির্ভর করে কোন মেথডে ভোটটা হচ্ছে তার ওপর। এটার জন্য প্রচুর অর্থও ব্যয় হয়। কাজেই আমরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করব টার্নআউটটা সেরকম হবে না।'

প্রবাসী ভোটারদের উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ইলেকশন কমিশনের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমন রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব আছে বলে মনে করেন আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, 'পার্টিগুলো ভোটারদের ভোট পাওয়ার জন্যই তো ক্যাম্পেইন করে। বাংলাদেশি যে কমিউনিটি দেশের বাইরে থাকে ওখানেও কিন্তু দলগুলোর সমর্থক আছে। কর্মী-সমর্থকরা আছে। তারাও এই কাজটা ওখানে করতে পারে।

'এটা তাদের কৌশল। আইনগতভাবে কোনো বাধা নেই।'

দেশের ভেতরে তিন শ্রেণির ভোটারের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে পোস্টাল ব্যালট।

এক্ষেত্রে অনলাইন নিবন্ধনের সুযোগ দেবে নির্বাচন কমিশন। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসনভিত্তিক ব্যালট পেপার আনা-নেওয়ার কাজটি করা হবে নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে।

ডাক বিভাগ পুরো কাজের তত্ত্বাবধানে থাকলেও নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসির এডহক কমিটির হাতে, যেখানে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও বিভাগের প্রতিনিধি থাকবেন।