‘জোট হলেও দলীয় প্রতীকে ভোট’ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দলগুলো
একাধিক রাজনৈতিক দল জোট করলেও নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে নিজ দলের প্রতীকে—এমন পরিবর্তন এনে সংশোধন করা হয়েছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আরপিওর ২০ নম্বর ধারায় আনা এই সংশোধনী প্রত্যাহারের বিষয়ে ভাবছে সরকার।যদিও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও খেলাফত মজলিস সতর্ক করেছে, এই সংশোধনী প্রত্যাহার করলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল অন্যায্য সুবিধা পাবে।গত ২৩ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে...
একাধিক রাজনৈতিক দল জোট করলেও নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে নিজ দলের প্রতীকে—এমন পরিবর্তন এনে সংশোধন করা হয়েছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আরপিওর ২০ নম্বর ধারায় আনা এই সংশোধনী প্রত্যাহারের বিষয়ে ভাবছে সরকার।
যদিও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও খেলাফত মজলিস সতর্ক করেছে, এই সংশোধনী প্রত্যাহার করলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল অন্যায্য সুবিধা পাবে।
গত ২৩ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জোট হলেও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিষয়টি পাস হয়।
এর লক্ষ্য ছিল, ভোটারদের কাছে প্রার্থীর দলীয় পরিচয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। তবে এ সংক্রান্ত কোনো গেজেট এখনো প্রকাশিত হয়নি।
একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, অন্তর্বর্তী সরকার আরপিওর ২০ নম্বর ধারায় আনা এই সংশোধনী প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন প্রস্তুতি পর্যালোচনা করেন। তারই উদ্যোগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
বিএনপি শুরু থেকেই এই সংশোধনের বিরোধিতা করছে। ২৫ অক্টোবর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংশোধনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই করা হয়েছে এবং এটি জোটভুক্ত দলের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে।
বিএনপি আগের বিধান বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে, যাতে জোটভুক্ত দলগুলো একটি প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করতে পারে।
একদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও গণভোট নিয়ে দলগুলোর মধ্যে চলছে উত্তেজনা। তার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হলো প্রতীক নিয়ে এই বিপরীত অবস্থান।
গত ২৯ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অনড় ও পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে সরকার সামনে এগোনোর পথ খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে।
এনসিপি গতকাল আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে অভিযোগ করেছে, তিনি বিএনপিকে আরপিও সংশোধনী প্রত্যাহারের আশ্বাস দিয়েছেন, যা সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করবে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আমরা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আপনি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ আইন উপদেষ্টা, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন।
দলটির দাবি, কোনো নিবন্ধিত দল অন্য দলের প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তা নিজের নিবন্ধনসংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যায়, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা দুর্বল করে এবং প্রার্থীর প্রকৃত পরিচয় গোপন করে।
দলটি সতর্ক করেছে যে এই সংশোধনী বাতিল করা হলে 'প্রক্সি প্রার্থিতা' উৎসাহিত হবে, কৃত্রিমভাবে বহুদলীয় প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পাবে, সংসদে প্রভাবশালী দলের কণ্ঠ আরও বলিষ্ঠ হবে এবং প্রকৃত বহুত্ববাদ ক্ষুণ্ণ হবে।
আখতার হোসেন এ বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বিএনপিকে গোপনে আশ্বাস দেওয়ার অভিযোগের কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। দ্য ডেইলি স্টার তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং হোয়াটসঅ্যাপে উত্তর দেননি।
জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সংশোধনী বাতিল করলে সবার জন্য সমান প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হবে এবং সরকার ও একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে গোপন বোঝাপড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
তিনি ইঙ্গিত দেন যে বিএনপির একজন নেতা ও সরকারের একজন উপদেষ্টার মধ্যে 'জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্ট' থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
একে অগণতান্ত্রিক আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই পরিবর্তন বাতিল করলে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি উপদেষ্টা মিলে সবার জন্য সমান সুযোগের পরিবেশ নষ্ট করার চক্রান্ত করেন, তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না।
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক ও মহাসচিব মাওলানা জালালউদ্দিন আহমদ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, কোনো দলকে সুবিধা দিতে আরপিও সংশোধন করা রাজনৈতিকভাবে অনৈতিক। এটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নষ্ট করবে এবং রাষ্ট্রকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে।
তারা সতর্ক করেন, এ ধরনের 'গোপন সমঝোতা' জনঅসন্তোষ উসকে দিতে পারে।
তাদের ভাষায়, জনগণ চায় প্রতিযোগিতা ও ভোটাধিকার, কোনো একটি দলকে সুবিধা দিতে সাজানো নির্বাচন নয়।
আমার বাংলাদেশ পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, অনুমোদনের অল্প সময়ের মধ্যেই সংশোধনী পরিবর্তনের অর্থ হলো—অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো নীতিগত অবস্থান নেই।
গতকাল ঢাকায় এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, সরকার কখনো বিএনপির চাপে ডানে ছুটছে, কখনো জামায়াতের চাপে বামে। আবার কখনো এনসিপির চাপে ওপরে।
তিনি আরও বলেন, কিছু দলকে খুশি করার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসুন। তা না হলে দেশের মানুষ যে সুযোগ আপনাদের দিয়েছে, তা নষ্ট করার দায় আপনাদেরই নিতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে মতভেদের প্রসঙ্গ টেনে মঞ্জু বলেন, রাষ্ট্র এখন তিনটি বিষয়ে গভীর সংকটে পড়েছে—গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে নাকি আগে হবে, ভিন্নমত কীভাবে বিবেচিত হবে এবং আসন্ন নির্বাচনের চরিত্র কী হবে।