'মা, বাবা এখনো বাসায় ফেরেনি। বাবা কোথায়? বলো না! আমাদের জন্য কোক আর চকলেট নিয়ে আসতে।' অবুঝ দুই শিশুর এই কথার জবাব কী হতে পারে জানা নেই কারও।

বাড়ির একপাশে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানে তখন আবুল কালাম আজাদের নিথর দেহ রাখা। আজাদের স্ত্রী আইরিন আক্তার চোখ মুছে বলেন, 'আমার অবুঝ দুটি বাচ্চা এখনো বুঝতেই শেখেনি, ওদের বাবা আর কখনোই ফিরে আসবে না!'

শেষবারের মতো দেখতে লাশবাহী গাড়ির জানালার পাশে ভিড় জমিয়েছেন স্বজনরা। বাড়ির সামনেও অনেক মানুষের ভিড়। ফ্রিজিং ভ্যানের কাঁচের জানালা বারবার ঘেমে যাচ্ছিল। আইরিন কাঁচ মুছতে মুছতে বিলাপ করতে থাকেন—'তুমি তোমার কলিজাদের এতিম করে কোথায় গেলা? এখন কে ওদের কোক আর চকলেট কিনে দেবে?'

গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় দুর্ঘটনায় নিহত হন আবুল কালাম আজাদ। মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে ঘটনাস্থলেই তার নিহত হন। রাত ২টার দিকে আজাদের মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামে পৌঁছালে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ।

উঠোনের একপাশে অঝরে কাঁদছিলেন আজাদের বড় ভাবী আসমা বেগম। তিনি বলেন, 'আমার শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ওকে (আজাদ) আপন ছেলের মতোই মানুষ করেছিলাম। ও আমাকে মায়ের মতোই দেখতো। ওর যত আবদার, অভিযোগ, বাড়ি এলে প্রথমে আমাকেই জানাতো।'

'গতকাল সকালে আমাকে ফোন দিয়ে বললো, নদীতে ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে, আমার জন্য কিছু পদ্মার ইলিশ কিনে রেখ। আমি বৃহস্পতিবার বাড়ি আসব। কিন্তু তার আগেই ওর লাশ এলো। এটাই যে ওর সাথে শেষ কথা হবে কে জানতো! আমি এই কষ্ট কোথায় রাখব। কাকে আর ইলিশ খাওয়াব?' বলেন আসমা।

আজাদ সপরিবারে নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। প্রায় ২০ বছর আগে কৈশোরে বাবা-মাকে হারান তিনি। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে আজাদ ছিলেন সবচেয়ে ছোট। বেড়ে ওঠেন বড় ভাই-বোনদের সংসারে। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন আজাদ। পরবর্তীতে দেশে ফিরে তিনি ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্যবসায় যুক্ত হন। ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের বাসিন্দা আইরিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের ছেলের বয়স পাঁচ বছর ও মেয়ের বয়স তিন বছর।

আইরিন স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন দুপুর ১২টার দিকে। তিনি বলেন, 'একজন ফোন দিয়ে বললো, আমার স্বামী অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, তাই ওকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আমি তখনো জানতাম না যে, আমার স্বামী মারা গেছে।'

কথা বলতে গিয়ে বারবার আইরিনের গলা জড়িয়ে আসে। তিনি বলেন, 'আমরা সাধারণ মানুষ, আমার স্বামীও সাধারণ মানুষ। কিন্তু সে কখনোই সন্তানদের সাধারণভাবে রাখেনি। সৎ উপায়ে যেভাবে পারতো রোজগার করতো, এর মধ্যেই আমাদের শখ পূরণ করতো। বাচ্চাদের জন্য কেনাকাটা, ঘোরাফেরার জন্য প্রতিদিন দুই হাজার টাকা খরচ করতো...আমার সব শেষ হয়ে গেল।'

একদিকে স্বামীকে হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আইরিন বলেন, 'আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমার বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কী হবে! কে ওদের দেখে রাখবে! আমাদের আর কেউ নাই। বাবা ছাড়া ওরা কীভাবে চলবে?'

'যে জিনিস পড়ে আমার স্বামী মারা গেল, তা যদি ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো, তাহলে আজ তাকে হারাতে হতো না। আমার সন্তানরা এভাবে এতিম হতো না। সরকার কি জানে না, এই মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে প্রতিদিন কত মানুষ চলাচল করে? তাহলে কেন তারা ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করল না? সঠিকভাবে কাজ করল না?' প্রশ্ন রাখেন তিনি।

আরও বলেন, 'আজকে আমার স্বামী মারা গেল। অন্য কেউ তো মারা যেতে পারতো, কালকে হয়তো অন্য কেউ মারা যেতে পারে। আমার মতো কাউকে যেন আর স্বামীহারা হতে না হয়। আর কোনো শিশুকে যেন এতিম হতে না হয়।'

সোমবার সকালে স্থানীয় পোরাগাছা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা মাঠে নামাজে জানাজা শেষে নড়িয়া পৌর কবরস্থানে আবুল কালাম আজাদের দাফন সম্পন্ন হয়।